Thursday, November 22, 2018

পানাম সিটির ট্রাজেডি


নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানার শহরের বাইরে এক পরিত্যক্ত প্রাচীন শহর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়ে আছে; নাম পানাম নগর। সাজানো গোছানো এমন একটি অভিজাত শহর হঠাৎ জনশুন্য হল কেন আমি তার উত্তর খুজে পাচ্ছিলাম না। নেট -এ ঘেটেও তেমন কোন উত্তর নেই। অথচ ওই পানার সিটির এক বাসিন্দা প্রাণ গোবিন্দ চক্রবর্তীর পুত্র বিশ্বনাথ চক্রবর্তী প্রতিদিনই কোর্টে আসে অামার সামনে বসা অ্যাডঃ ভুপেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর কাছে। দীর্ঘ ১৮ বছর পর তার মুখে শুনলাম সেই করুন ট্রাজেডি।









ঘটনার দিন তার মা বাবার বাড়ীতে এসেছিলেন ঢাকায়, তার বাবা গিয়েছিলেন জজমানের বাগড়ীতে পৌরোহিত্য করতে ; তাই তারা বেঁচে গিয়েছিলেন।

১৯৬৪ সালের জানুয়ারীর ২ তারিখ। কাশ্মিরের হযরত বাল মসজিদ থেকে হযরত মুহম্মদের একগুচ্ছ চুল হারানো গেছে এই মিথ্যা গুজব ছড়ায় দুষ্কৃতিকারীরা। অার অমনি রে রে করে হাজার হাজার মুসলিম জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে বর্ধিষ্ণু হিন্দু শহর মানাম নগরে। মুহুর্তের মধ্যে কচুকাটা হয় শহরের কয়েক হাজার বাসিন্দা। প্রতিটি বাড়ীতে রক্তের স্রোত বয়ে যায়; বাদ যায়নি নারী শিশু। কেউ প্রাণে বাঁচতে পারেনি। দু' পাশের খাল দিয়ে রক্তের স্রোত বয়ে যায়। জনশুন্য হয়ে যায় ২০০ বছর ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা একটি বর্ধিষ্ণু হিন্দু শহর। ঈশা খাঁর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে হিন্দু ধনিক ব্যবসায়ীরা একত্র হয়ে একটি শহর গড়ে তুলেছিলো। নিরাপত্তার জন্য চারপাশে কৃত্তিম খাল কেটে জল দূর্গ গড়ে তুলেছিল তারা। আজ করুণ দৃষ্টিতে সারি সারি দাঁড়ায়ে আছে জৌলুসময় বিশাল বিশাল অট্টলিকা। আজ হাজার হাজার মানুষ টিকিট কেটে দেখতে যায় পানাম নগর; কিন্তু কেউ জানে না এর করুন ইতিহাস। হাজার হাজার মানুষের আর্ত চিৎকার আর ক্রন্দনধ্বনি আকাশে বাতাসে আজও ঘুরে ফেরে। নিরবে কান পাতলে শোনা যায় ক্রন্দন আর আর্ত চিৎকার। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বাড়ীগুলো বসবাসের জন্য লীজ দিয়েছিলো, কিন্তু কেউ থাকতে পারেনি। রাতে সেই অতৃপ্ত আত্মাগুলো ঘুরে ফেরে প্রতিটি বাড়ী। এর মধ্যে একটি বাড়ী আছে বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর। জজ কোর্ট, হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্টের অ্যপিলেট ডিভিশনে জেতার পরও সরকার ফিরিয়ে দেয়নি তার বাড়ীটি। নগরীটির দখলসত্বে মালিক এখন সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের অধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। অসাম্প্রদায়িক! মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর সহ তার অধিন্তদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোন ক্ষতিপূরণ পাননি। এই মন্ত্রী বরং যাতে জমি বাড়ী ফেরৎ না পায় তার জন্য হাইকোর্টে রীট করেছেন একাধিকবার, ফল বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর পক্ষে। তবুও দেয়নি বাড়ী বা তার ক্ষতিপুরন। এই আমাদের হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক দেশ।

শ্রীকৃষ্ণের রাস-লীলা পবিত্র প্রেমভক্তি ।

সবাইকে জানাই শ্রীকৃষ্ণের রাস-লীলা, রাস-পূর্ণিমা, রাস-যাত্রার রাধাকৃষ্ণ প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
আসুন জেনে নেই রাসলীলা সম্পর্কে।

সর্বেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার বিভূতি শ্রীমতি রাধারাণী সহিত গোপীকাগণ কে নিয়ে বৃন্দাবনের রাগমন্ডলে মহারাস লীলা করেন।


(১) রাস কী ?
উঃ ঈশ্বরের সাথে আত্মার মহামিলনই রাস ।

(২) গোপী কে ?
উঃ আত্মা, যারা তাদের পূণ্যবলে ভগবানের সাথে মিলিত হয়েছে ।
রাসে কী দৈহিক কাম বাসনা জাগ্রত হয় ?
উঃ কখনোই না কারণ দৈহিক কামনা বাসনার দেবতা কামদেব যখন রাস মন্ডলে এসে দৈহিক কাম ছরাতে চেয়েছিল তখন ভগবান তাকে কদম গাছের সাথে বেধে রেখেছিল । কারণ, পরমাত্মার সাথে আত্মার মিলনে কোন কামনা বাসনা থাকে না, শুধু থাকে পবিত্র প্রেমভক্তি !

(৩) রাসলীলার নামে পুরুষ-মহিলার নৃত্যকীর্তনের যৌক্তিকতা কি ?
উঃ রাসলীলা কখনই অনুকরণীয় নয় । প্রজাপতি ব্রহ্মা, মহাদেব শিব, স্বর্গরাজ ইন্দ্র, সমস্ত দেব-দেবী, গন্ধর্ব, অপ্সরা-কারও পক্ষে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধারাণীর রাসলীলা অনুপ্রবেশ বা অনুকরনের যোগ্য নয় । তবে সে বিষয়ে মানুষের পক্ষে আর কি কথা ? শ্রীব্রহ্মা ষাট হাজার বছর তপস্যা করেও ভগবদহ্লাদিনী শক্তি ব্রজগোপিকাগণের চরণের ধূলিকণা মাত্র লাভ করার আকাঙ্ক্ষাও পূরণ করতে সক্ষম হননি । বৈকুন্ঠের লহ্মীদেবী শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলায় প্রবেশ করার সৌভাগ্য পর্যন্ত লাভ করতে পারেননি, তাই তিনি যমুনার অপর পারে কৃষ্ণপাদপদ্ম ধ্যানেই উপবিষ্ট হয়ে থাকলেন । মহাদেব শিব রাসলীলা দর্শনে গিয়েই বঞ্চিত হয়েছিলেন । অতএব যেখানে এইরকম অবস্থা ঘটে, সেই ক্ষেত্রে কি করে মল-মূত্র-কফ-পিত্ত বিশিষ্ট আধিব্যাধিযুক্ত, ধর্মনিষ্ঠাহীন, ব্রতহীন, কামুক লম্পট দুরাচারী, মদ্যমাংস প্রিয়, নেশাসেবী, জড়বুদ্ধিসর্বস্ব এঁচড়ে পাকাদের দল নিজেরাই রাধাকৃষ্ণ সেজে রাসলীলা করতে পারে  বা রাধাকৃষ্ণ তত্ত্ব সম্বন্ধে বাজে কথা বলতে পারে……

সুতরাং, যারা রাসলীলা সম্পর্কে অপপ্রচার করে তাদের উচিত শ্রীমদ্ভাগবত পড়া, আমাদের শাস্ত্র পড়লে তারা বুঝতে পারবে রাস শুধু নৃত্যগীত নয় । আধ্যাত্মিকতার এক বড় পরিনতি ।

জয় রাধারাণী, জয় গোপীগণ
জয় নিতাই।

Friday, November 9, 2018

ভাই ফোঁটা/ভ্রাতৃদ্বিতীয়া


মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে সংস্কৃতির রয়েছে এক অদৃশ্য যোগসূত্র। সেই ধারায় অনেক আচার-অনুষ্ঠান শতাব্দীর পর শতাব্দী পালিত হয়ে আসছে নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে। এমনই একটি সংস্কার ‘ভাই ফোঁটা’। ভাইফোঁটা হিন্দুদের একটি উৎসব। এই উৎসবের পোষাকি নাম ভ্রাতৃদ্বিতীয়া অনুষ্ঠান। কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে (কালীপূজার দুই দিন পরে) এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাঙ্গালী হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী, এই উৎসব কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ২য় দিন উদযাপিত হয়। মাঝেমধ্যে এটি শুক্লপক্ষের ১ম দিনেও উদযাপিত হয়ে থাকে। পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ভাইদুজ নামেও পরিচিত। সেখানে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পাঁচ-দিনব্যাপী দীপাবলি উৎসবের শেষদিন। আবার, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে বলে ভাইবিজ। নেপালে ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসব পরিচিত ভাইটিকা নামে। সেখানে বিজয়াদশমীর পর এটিই সবচেয়ে বড় উৎসব।
মৃত্যুদূত যম ও যমুনা যমজ ভাইবোন। সূর্যের ঔরসে জন্ম তাদের। বড় হওয়ার পর দুজনে আলাদা হয়ে যান। থাকতেন পরস্পর থেকে অনেক দূরে। লম্বা সময়ের ব্যবধানে যমুনার খুব ইচ্ছে হলো ভাইকে দেখতে। বার্তা পাঠালেন তাকে। বোনের নিমন্ত্রণে যমরাজকে আসতেই হলো। যথাসাধ্য আপ্যায়ন করলেন যমুনা। ফেরার সময় আবারো আসার প্রতিশ্রুতি দিলেন যম। তখন খুশিতে ভাইকে আশীর্বাদ করে টিকা পরিয়ে দিলেন কপালে। সেই থেকেই নাকি ভাই ফোঁটার প্রচলন।
আরও একটা কাহিনী পাওয়া যায় যমরাজ সম্পর্কে তা হল- কার্তিকেয় শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে যমুনাদেবী তাঁর ভাই যমের মঙ্গল কামনায় গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে পুজা করেন। তাঁরই পুণ্যপ্রভাবে যমদেব অমরত্ব লাভ করেন। বোন যমুনা দেবীর পুজার ফলে ভাই যমের এই অমরত্ব লাভের চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে বর্তমান কালের বোনেরাও এই সংস্কার বা ধর্মাচার পালন করে আসছে।
অন্য মতে, নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর যখন কৃষ্ণ তাঁর বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁকে মিষ্টি খেতে দেন। সেই থেকে ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয়।
যম-যমুনা বা কৃষ্ণ-সুভদ্রা, যাদের দ্বারাই এ অনুষ্ঠানের প্রচলন হোক না কেন, আজো তা বজায় রয়েছে। ভাই-বোনের মধ্যেকার অনিন্দ্যসুন্দর সম্পর্ক ঘিরেই প্রচলিত হয়েছে এই উৎসবটি। ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় ঈশ্বরের কাছে বোনের আকুতি, ভাইয়ের সাফল্য, দীর্ঘায়ু লাভের জন্য বোনের প্রার্থণাই ‘ভাইফোঁটা’ কে মহিমান্বিত করেছে। প্রথা অনুযায়ী শুক্লাতিথির দ্বিতীয়াতে ভাইফোঁটা উদযাপিত হয়। প্রয়োজনে পরবর্তী সাতদিন ভাইফোঁটা উদযাপণ করা যায়। পঞ্জিকার হিসেবমতে কালীপূজার দুই দিন পরে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠিত হয়। ভাইফোঁটার ধর্মীয় গুরুত্ব অপেক্ষা সামাজিক ও পারিবারিক গুরুত্ব অনেক বেশী, যেখানে ভাই-বোনের মধ্যেকার প্রীতি ও ভালোবাসার স্বর্গীয় সম্পর্কটিই মূখ্য। ভাই বোন দুজনেই বছরের এই একটি দিনের অপেক্ষায় থাকে।
ভাইফোঁটা এমনই এক উৎসব যা ভাই-বোনের মধ্যেকার ভালোবাসা এবং স্নেহের সম্পর্ক খুব দৃঢ় করে। ভাই-বোনে সারা বছর ঝগড়া-ঝাঁটি থাকলেও, ভাই বোন দুজনেই বছরের এই একটি দিনের অপেক্ষায় থাকে। বোনের কাছ থেকে ভাইফোঁটার নেমন্তন্ন পেলে, দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে, যত প্রয়োজণীয় কাজ ঠেলে সরিয়ে রেখে ভাই আসবেই বোনের কাছ থেকে ফোঁটা নিতে।
ভাই বাইরে যতই প্রভাবশালী হোক, বোনের কাছে এলেই শিশু হয়ে যায়, বোন বয়সে বড়ই হোক অথবা ছোট হোক, মায়ের পরেই স্নেহময়ীর পদটি তার দখলে চলে যায়। ভাইয়ের কল্যান কামনায় বোন সবসময় ঈশ্বরের কাছে তার দুই হাত তুলে রাখে।
ভাইফোঁটা যেভাবে উদযাপিত হয়ঃ
সাধারণতঃ শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াতে ভাইফোঁটা্র লগ্ন ঠিক হয়। এই হিসেব ধরেই বোন তার ভাইদেরকে নিমন্ত্রণ জানায় তার বাড়ীতে। কাছে-দূরে যেখানেই থাকুক, বোনের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে ভাইয়েরা ছুটে আসে। এই দিন বোনেরা উপবাস রেখে ঠিক সন্ধ্যাবেলা ভাইকে আদর সমাদর করে বসতে দেয়া হয় নকশিকাঁথার কাজ করা সূতির আসনে। বোনের হাতে থাকে ঝকঝকে পেতলের রেকাবী। কাঁসা বা পিতলের থালায় ধান-দূর্বা,ঘরে তৈরী কাজল,(চন্দন বাটা, ঘি, কাজল, মধু ,শিশির শুকনো পাটপাতা দিয়ে), মিষ্টি। পাশেই রাখা হয় ঘিয়ের প্রদীপ। বোন তার কড়ে আঙুলে কাজল ছুঁইয়ে ভাইয়ের দুই ভুরুতে এঁকে দেয়। এরপর চন্দনের ফোঁটায় কপাল অংকিত করে, কপালের ঠিক মাঝখানে কড়ে আঙুলকে স্পর্শ করে ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে থাকে। বোনেরা যে মন্ত্রটি পাঠ করে –
“ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দেই আমার ভাইকে ফোঁটা।

যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে আমার ভাই হোক অমর॥”
আজ থেকে আমার ভাই, যম দুয়ারে তিতা।


 ছড়া শেষে বোন ভাইয়ের মাথায় ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে, পাশ থেকে বেজে উঠে উলুধ্বনি আর শংখধ্বনি। শংখধ্বনিতে ভাইয়ের জীবন থেকে সকল বালা –মুসিবত দূর হয়ে যায়, ভাইয়ের মুখে একটু তেতো নিমপাতা বা পাটপাতা তুলে দিতে হয়। ভাইকে তেতো মুখে বেশীক্ষণ থাকতে হয়না, সাথে সাথে থালা ভর্তি মিষ্টি খেতে দেয়া হয়। শুধু কী মিষ্টি? মিষ্টির সাথে ভাইকে বোনের পক্ষ থেকে উপহার দেয়া হয়। অবশ্য কোন কিছুই একতরফা হয়না। বোন যেমন ভাইকে দেয়, ভাইও বড় বোনকে প্রনাম শেষে দিদির হাতে উপহার তুলে দেয়। আর বোন যদি বয়সে ছোট হয়, তাহলে বড় ভাইকে প্রনাম করে, ছোট বোনের হাতে উপহার তুলে দিতে ভাইয়ের আনন্দের সীমা থাকেনা। এভাবেই ভাই-বোনের মধ্যে ভালোবাসা ও প্রীতির সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। এই ছোট্ট আনুষ্ঠানিকতা শেষে পরিবারের সকলে মিলে আরও বড় পরিসরের আনন্দ-উৎসবে মিলিত হয়। বছরের অন্য দিনগুলোতে খাবারের মান যতই সাধারণ হোক না কেনো, ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানে ভাইয়ের পছন্দের খাবার রান্না করা হয়। বোনের যতটুকু সাধ্য, ভাইকে তা উজার করে দিয়ে সুখী হয়।
 

Wednesday, August 17, 2016

প্রণাম মন্ত্রঃ (বাংলা অনু্বাদ সহ)

  প্রণাম মন্ত্রঃ
শ্রীগুরুর প্রণাম
ওঁ অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ।।
অনুবাদঃ অজ্ঞতার গভীর অন্ধকারে আমার জন্ম হয়ে ছিল এবং আমার গুরুদেব জ্ঞানের আলোক বর্তিকা দিয়ে আমার চক্ষু উন্মীলিত করলেন। তাকেঁ জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি।
শ্রীকৃষ্ণের প্রণাম
হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধো দীনবন্ধো জগৎপতে।
গোপেশ গোপীকাকান্ত রাধাকান্তায় নমোহস্তুতে।।
অনুবাদঃ হে আমার প্রিয় কৃষ্ণ, তুমি করুণার সিন্ধু, তুমি দীনের বন্ধু, তুমি সমস্ত জগতের পতি, তুমি গোপিকাদের ঈশ্বর এবং শ্রীমতি রাধারাণীর প্রেমাষ্পন্দ, আমি তোমার শ্রীপাদ্‌পদ্মে সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।
শ্রী রাধারাণীর প্রণাম
অনুবাদঃ তপ্তকাঞ্চন গৌরাঙ্গীরাধে বৃন্দাবনেশ্বরী।
বৃষভানুসূতে দেবী ত্বং নমামি কৃষ্ণপ্রিয়ে।।
অনুবাদঃ শ্রীমতি রাধারাণী, যার অঙ্গকান্তি তপ্ত কাঞ্চনের মতো এবং যিনি বৃন্দাবনের ঈশ্বরী, যিনি মহারাজ বৃষভানুর দুহিতা এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রেয়সী, তাঁর চরণকমলে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাই।
শ্রী শ্রী তুলসীদেবীর প্রণাম
ওঁ বৃন্দায়ৈ তুলসীদেব্যৈ প্রিয়ায়ৈ কেশবস্য চ।
কৃষ্ণভক্তি প্রদে দেবী! সত্যবত্যৈ নমো নমঃ।।
অনুবাদঃ কেশবপ্রিয় বৃন্দাদেবী যিনি কৃষ্ণ-ভক্তি প্রদান করেন, সেই সত্যবতী তুলসী দেবীকে আমি বার বার প্রণাম নিবেদন করি।
শ্রীগৌরাঙ্গ প্রণাম
নমো মহাবদান্যায় কৃষ্ণপ্রেমপ্রদায় তে।
কৃষ্ণায় কৃষ্ণচৈতন্যনাম্নে গৌরত্বিষে নমঃ।।
অনুবাদঃ আমি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই, যিনি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এবং অন্যান্য অবতার অপেক্ষা উদার, তিনি অত্যন্ত দুর্লভ কৃষ্ণপ্রেম প্রদান করেছেন, তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাই।
শ্রী শ্রী পঞ্চতত্ত্ব প্রণাম
পঞ্চতত্ত্বাত্মকং কৃষ্ণং ভক্তরূপস্বরূপকম্‌।
ভক্তাবতারং ভক্তাখ্যং নমামি ভক্তশক্তিকম্‌।।
অনুবাদঃ ভক্তরূপ, ভক্তস্বরূপ, ভক্ত অবতার, ভক্ত এবং ভক্ত শক্তি এই পঞ্চতত্ত্বাত্মক শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণ কমলে প্রণতি নিবেদন করি। (ভক্তরূপ-শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, ভক্তস্বরূপ-নিত্যানন্দ প্রভু, ভক্তাবতার-অদ্বৈত আচার্য প্রভু, ভক্ত-শ্রীবাস ঠাকুর, ভক্তশক্তি-শ্রীগদাধর পন্ডিত)
শ্রী শ্রী বৈষ্ণব প্রণাম
বাঞ্ছা কল্পতরুভ্যশ্চ কৃপাসিন্ধুর্ভ এব চ।
পতিতানাং পাবনেভ্য বৈষ্ণবেভ্য নমো নমঃ।।
অনুবাদঃ সমস্ত বৈষ্ণব ভক্তবৃন্দ, যাঁরা বাঞ্ছাকল্পতরুর মতো সকলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে পারেন, যাঁরা কৃপার সাগর এবং পতিত পাবন, তাদের চরণ কমলে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।
পঞ্চতত্ত্ব মহামন্ত্র
(জয়) শ্রীকৃ্ষ্ণচৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ।
শ্রীঅদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাদি গৌরভক্তবৃন্দ।।
অনুবাদঃ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, প্রভু নিত্যানন্দ, শ্রীঅদ্বৈত আচার্য, শ্রীগদাধর এবং শ্রীবাস আদি গৌরভক্তবৃন্দের জয় হোক।
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
 
 
-:ত্রিসন্ধ্যা বিধি:-
দিবাভাগে পূর্ব্বমুখ এবং রাত্রিভাগে উত্তরমুখ হয়ে পদ্মাসনে উপবেশন পূর্ব্বক।
জলশুদ্ধি:-
 ওঁ গঙ্গে চ যমুনেচৈব গোদাবরি সরস্বতী।
নর্মদে সিন্ধুকাবেরি জলেহস্মিন্‌ সন্নিধিং কুরু।।
আচমন:- দুই বার।
ওঁ বিষ্ণু, ওঁ বিষ্ণু, ওঁ বিষ্ণু, ওঁ তদ্বিষ্ণো পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সুরয়ঃ। দিবীব চক্ষুরাততম্‌ নমো অপবিত্রঃ পবিত্রোবা সর্ব্বাবস্থাং গতোহপি বা যঃ স্মরেৎ পুন্ডরীকাক্ষং সঃবাহ্য অভ্যন্তরঃ শুচি।।
বিষ্ণু স্মরণ:-
ওঁ শঙ্খচক্রধরং বিষ্ণুং দ্বিভুজম্‌ পীতবাসসম্‌।
প্রারম্ভে কর্ম্মানাঙ বিপ্রঃ পুন্ডরীকং স্মরেৎ হরিম্‌।।
তিলক গুলিবার মন্ত্র:-
ওঁ নমো কেশবানন্ত গোবিন্দ বরাহ পুরুষোত্তম।
পূণর্যশাস্যামায়ুস্যং তিলকং মে প্রসীদতু।।
তিলক ধারণ মন্ত্র:-
১. ললাটে- শ্রী কেশবায় নমঃ
২. উদরে- শ্রী নারায়ণায় নমঃ
৩. বক্ষঃস্থলে- শ্রী মাধবায় নমঃ
৪. কন্ঠে- শ্রী গোবিন্দায় নমঃ
৫. দক্ষিণ কুক্ষিতে- শ্রী বিষ্ণুবে নমঃ
৬. দক্ষিণ বাহুতে- শ্রী মধুসূদনায় নমঃ
৭. দক্ষিণ স্কন্ধে- শ্রী ত্রিবিক্রমায় নমঃ
৮. বাম কুক্ষিতে- শ্রী বামনায় নমঃ
৯. বাম বাহুতে- শ্রী শ্রীধরায় নমঃ
১০.বাম স্কন্ধে- শ্রী হৃষীকেশায় নমঃ
১১. পৃষ্ঠে- শ্রী পদ্মনাভায় নমঃ
১২. কটিতে- শ্রী দামোদরায় নমঃ
অতঃপর হস্ত ধৌত জল “ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়” বলিয়া হস্ত ধৌত জল স্বীয় মস্তকে ধারণ করিবেন।
 

Monday, August 15, 2016

অঙ্গষ্পর্শঃ-

দুই বা ততোধিক ডুব দিয়ে গামছা অথবা তোয়ালে দিয়ে রগড়ে শরীরে মাখানো তেল মুছে ফেলে দিতে হবে। শুকনো কাপড় পড়ে জলের নিকট বসে নিম্ন মন্ত্রে আচমন এবং অঙ্গস্পর্শ করতে হবে-
ওম্‌ শংনো দেবীরভিষ্টয় আপো ভবন্তু পীতয়ে।
শংয়োরোভি স্রবন্তু নঃ ।। ঋগবেদ ১০/৯/৪, সামবেদ ১/৩/১২

স্নান করি শান্তি নিরে, সবে মাত্র উঠনু তীরে
পূন্য জল পূর্ণ বহুক দেহে।
বহুক সদা সুখ শান্তি, দুরে যাক মোহ ভ্রান্তি
মন যেন সদা সুখে রহে।

অঙ্গষ্পর্শঃ-
ক) ওম্‌ বাঙ্ম আসন (উপরের ওষ্ঠ নিচের ওষ্ঠ)
গ) চক্ষু রক্ষ্ণোঃ (ডান চোখ বাম চোখ)
ঙ) ওম্‌ অপলিতা কেশাঃ (চুল)
ছ) ওম্‌ বহোবর্মে যশোবলম্‌ (ডান বাহু বাম বাহু)
ঝ) ওম্‌ জঙ্ঘয়ো জবঃ (ডান জঙ্ঘা বাম জঙ্ঘা)
ট) ওম্‌ নাভ্যম্‌ (নাভী)
ড) ওম্‌ কন্ঠম্‌ (কন্ঠ)
খ) নসো প্রানঃ (ডান নাক বাম নাক)
ঘ) ওম্‌ শ্রোত্রং কর্ণয়ো ( ডান কান বাম কান)
চ) ওম্‌ আশোনা দন্তুাঃ (দাঁত)
জ) ওম্‌ ঊর্বোরোজো (ডান উরু বাম উরু)
ঞ) ওম্‌ পাদায়োঃ প্রতিষ্ঠা (ডান পা বাম পা)
ঠ) ওম্‌ হৃদয়ম্‌ (হৃদয়)
ঢ) ওম্‌ অরিষ্টানি মেহঙ্গানি তনূস্তাণা মে সহ সন্তু (সর্বাঙ্গে)

Sunday, August 14, 2016

হিন্দু শাস্ত্রীয় “বিবাহ”

স্মৃতি শাস্ত্রের বিখ্যাত গ্রন্থ মনুসংহিতায় আট প্রকার বিবাহের কথা বলা আছে। সেগুলো হল:-

(১) ব্রাহ্ম
(২) আর্য
(৩) প্রাজাপত্য
(৪) আসুর
(৫) গান্ধর্ব
(৬) রাক্ষস
(৭) দৈব

(৮) পৈশাচ

জাতি এবং শ্রেণী বিভাগে এই বিবাহ গুলো হয়ে থাকে তবে ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য বিবাহ রীতি গুলোই প্রচলিত। বর্তমান মানব সমাজে ব্রাহ্ম বিবাহই স্বীকৃত এবং পালনীয়।
ব্রাহ্ম বিবাহ হল – কন্যাকে বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদন করে এবং অলংকার দ্বারা আচ্ছাদন করে বিদ্বান ও সদাচারী বরকে স্বয়ং আমন্ত্রন করে যে কন্যা দান করা হয়তাকে ব্রাহ্মবিবাহ। বর্তমানে কেউ না মানলেও সমাজে গান্ধর্ব বিবাহের প্রচলন আছে। নারী-পুরুষ পরস্পর শপথ করে মাল্যবিনিময়ের মাধ্যমে যে বিবাহ করে তার নাম গান্ধর্ব বিবাহ। এর উদাহরণ, মহাভারতে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার বিবাহ গাদ্ধর্ব বিবাহ ছিল।
বেদে খুব পরিষ্কার ভাবে বলা হয়েছেঃ
উদীর্স্বাতো বিশ্বাবাসো নমসেলামহে ত্বা ।
অন্যামিচ্ছ প্রফর্ব্যং সং জায়াং পত্যা সৃজ ।।১০/৮৫/২২।।
—অর্থাত্ তুমি যাও ও অবিবাহিত নারীকে তোমার অর্ধাঙ্গিণী কর এবং তাকে সমান অধিকার প্রদান কর।
আমাদের সনাতন বিবাহে কত গুলো বিধিবিধান শাস্ত্রীয়, কিছু অনুষ্ঠান আচার রয়েছে। শুভলগ্নে নারায়ণ, অগ্নি, শিব, দূর্গা, গুরু ইত্যাদি দেবতাকে আহবান করে এবং পুরোহিত আত্মীয় স্বজনদের সাক্ষী করে মঙ্গল মন্ত্রের উচ্চারণ, উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে বিবাহনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। বিয়ের মন্ত্রের শেষ হয় যজ্ঞের মাধ্যমে।
বিবাহের মূল মন্ত্র যা স্বামী স্ত্রীরা প্রতিজ্ঞা করে থাকে :
“যদেতত্ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম ।
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব ।।”
—তোমার এই হৃদয় আমার হোক আমার এইহৃদয় তোমার হোক।
বিবাহের মাধ্যমে একজন নারীপুরুষ চীর জীবন একসাথে সুখে দুঃখে থাকবার প্রতিজ্ঞা করে। বিবাহ আমাদের সনাতন ধমেঃর একটি অন্যতম অংশ। প্রত্যেকেরই জীবনকে পরিপূর্ণ করতে বিবাহ করা আবশ্যক।

বিবাহ অনুষ্ঠান

বাঙালি ব্রাহ্মণ সমাজে পাঁচটি শাখা রয়েছে — রাঢ়ী, বারেন্দ্র, বৈদিক, সপ্তশতী ও মধ্যশ্রেণী। বাঙালি কায়স্থ সমাজে রয়েছে চারটি শাখা — উত্তর রাঢ়ী, দক্ষিণ রাঢ়ী, বারেন্দ্র ও বঙ্গজ। এই সকল বর্ণ এবং তাদের শাখা ও উপশাখাগুলির মধ্যে বিবাহ প্রথায় দুটি বিভাগ দেখা যায় — বৈদিক ও লৌকিক। লৌকিক প্রথাগুলি মেয়েলি আচার। এই কারণে এগুলি ‘স্ত্রী আচার’ নামে পরিচিত। বৈদিক আচারে সাম, যজুঃ ও ঋক্ বেদত্রয়ের অনুসরণকারী ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিবাহ প্রথায় আবার সামান্য পার্থক্য দেখা যায়। হিন্দু বিবাহের বৈদিক আচারগুলির মধ্যে অপরিহার্য হল কুশণ্ডিকা, লাজহোম (লাজ বা খই দিয়ে যজ্ঞানুষ্ঠান), সপ্তপদী গমন, পাণিগ্রহণ (কন্যার পাণি অর্থাৎ হস্ত গ্রহণ), ধৃতিহোম (ধারণ করার অর্থাৎ কন্যাকে ধরে রাখার যজ্ঞ) ও চতুর্থী হোম। এছাড়া পালিত হয় অরুন্ধতী নক্ষত্র দর্শন, ধ্রুব নক্ষত্র দর্শন, শিলারোহণ ইত্যাদি কয়েকটি বৈদিক প্রথাও।বৈদিক প্রথাগুলি বিধিবদ্ধ শাস্ত্রীয় প্রথা ও বিবাহের মূল অঙ্গ।
বাঙালি হিন্দু বিবাহের লৌকিক আচার বহুবিধ। এই প্রথাগুলি বর্ণ, শাখা, উপশাখা এবং অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের হয়। এগুলির সঙ্গে বৈদিক প্রথাগুলির কোনো যোগ নেই।

পাটিপত্র

পাটিপত্র বাঙালি হিন্দু বিবাহের প্রথম আচার। এই আচার লগ্নপত্র বা মঙ্গলাচরণ নামেও পরিচিত। ঘটকের মাধ্যমে সম্বন্ধ করে বিবাহ স্থির হলে নগদ বা গহনাপত্রে যৌতুক ও অন্যান্য দেনাপাওনা চূড়ান্তভাবে স্থির করার জন্য যে অনুষ্ঠান হয়, তাকেই পাটিপত্র বলে। এই আচারের মাধ্যমেই বিবাহের অন্যান্য আচারের সূচনা ঘটে।[১]

পানখিল

পানখিল বাঙালি হিন্দু বিবাহের দ্বিতীয় আচার। এটি পাটিপত্রের ঠিক পরেই পালিত হয়। পানখিলের অর্থ পান পাতায় আনুষ্ঠানিকভাবে খিল দেওয়া বা খড়কে বেঁধানো। এই আচারটি প্রথমে বরের বাড়িতে এবং পরে কনের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। পানখিল আচারে বাড়ির মেয়েরা এবং প্রতিবেশিনীরা বিয়ের গান গেয়ে থাকে। এই গানের বিষয়বস্তু হল রাম ও সীতার বিবাহ।[১]

দধি মঙ্গল

দধি মঙ্গল: বিবাহের দিন বর ও কন্যার উপবাস। তবে উপবাস নির্জলা নয়। জল মিষ্টি খাওয়ার বিধান আছে। তাই সারাদিনের জন্য সূর্য্যোদয়ের আগে বর ও কন্যাকে চিড়ে ও দৈ খাওয়ানো হয়।

গায়ে হলুদ

গায়ে হলুদ: সংস্কৃত ভাষায় এই রীতিকে বলা হয় গাত্রহরিদ্রা। হিন্দু ধর্মে কয়েকটি জিনিসকে শুভ বলা হয়। যেমন শঙ্খধ্বনি, হলুদ ইত্যাদি। প্রথমে বরকে ও নিতবরকে সারা গায়ে হলুদ মাখানো হয়। পরে সেই হলুদ কন্যার বাড়ি পাঠানো হয়। কন্যাকে সেই হলুদ মাখানো হয়।

শঙ্খ কঙ্কন

শঙ্খ কঙ্কন: কন্যাকে শাঁখা পরানো হয়।
এরপর বিকালে বিবাহের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়

বর বরণ

বর বরণ: বর বিবাহ করতে এলে তাকে স্বাগত জানান কন্যাপক্ষ। সাধাবনত: কন্যার মা তার জামাতাকে একটি থালায় প্রদীপ, ধান দুর্ব্ব ও অন্যান্য কিছু বরণ সামগ্রী নিয়ে বরণ করেন। এরপর বরকে বাড়ীর ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয় ও দুধ এবং মিষ্টি খাওয়ানো হয় ।

সাত পাক

সাত পাক: বিবাহের মণ্ন্ডপে প্রথমে বরকে আনা হয়। এরপর কন্যাকে পিঁড়িতে বসিয়ে আনা হয়। সাধারণত: কন্যার জামাইবাবুরা পিঁড়ি ধরে থাকেন। কন্যা পান পাতা দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রাখেন। কন্যাকে পিঁড়িতে করে বরের চারপাশে সাতপাক ঘোরানো হয়।

শুভদৃষ্টি

শুভদৃষ্টি: বিবাহের মন্ডপে জনসমক্ষে বর ও কন্যা একে অপরের দিকে চেয়ে দেখন।

মালা বদল

মালা বদল: কন্যা ও বর মালাবদল করেন। এই রীতির অর্থ হচ্ছে দুজন একে অন্যকে জীবনসঙ্গী হিসাবে মেনে নিলেন। মুসলমান মতে একই ভাবে কন্যাকে বলতে হয় "কবুল"। আবার ঠিক এই রকমই খৃষ্টান মতে চার্চের ফাদারের সামনে বর ও কন্যা বিবাহে সন্মতি জানান।

সম্প্রদান

সম্প্রদান: কন্যার পিতা কন্যাকে জামাতার হাতে সম্প্রদান করেন বেদমন্ত্রে। বরও জানান যে তিনি কন্যার ভরন পোষনের দ্বায়িত্ব নিলেন। বিবাহের মন্ত্র হল " যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।।"

অঞ্জলি

অঞ্জলি: কন্যা ও বর খৈ অগ্নাহুতি দেন। প্রচলিত বাংলায় একে বলে খৈ পোড়া। বৈদিক যুগে মানুষ নানা ধরনের শক্তির উপাসনা করতেন। অগ্নিও তাদের মধ্যে অন্যতম।

সিঁদুর দান

সিঁদুর দান: বিবাহের শেষ রীতি হল বর কন্যার কপালে সিঁদুর লেপন করেন। বাঙালি হিন্দু নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় সিঁদুর পরেন।

ভেদাভেদ

জাতিভেদে ও অঞ্চলভেদে এই রীতি কিছু পরিবর্তিত হয়। লৌকিক আচারগুলি অঞ্চল, বর্ণ বা উপবর্ণভেদে এক এক প্রকার হয়।[১] নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে লৌকিক আচার তো বটেই বিবাহের মৌলিক আচারগুলির ক্ষেত্রেও সম্প্রদায়ভেদে পার্থক্য লক্ষিত হয়।



হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শাস্ত্রীয় বিবাহের দালিলিক প্রমাণ সুরক্ষার লক্ষ্যে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন
সম্পর্কিত বিধানাবলী প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রণীত আইন

 
যেহেতু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শাস্ত্রীয় বিবাহের দালিলিক প্রমাণ সুরক্ষার লক্ষ্যে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন সম্পর্কিত বিধানাবলী প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়
 
 
 বিদ্র: যৌতুক একটি অভিষাপ। হিন্দু শাস্ত্রীয় মত এবং 
  সংক্ষিপ্ত শিরোনাম, প্রয়োগ ও প্রবর্তন  
১। (১) এই আইন হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন, ২০১২ নামে অভিহিত হইবে।

(২) ইহা নাগরিকত্ব নির্বিশেষে বাংলাদেশে বসবাসরত সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বীর জন্য প্রযোজ্য হইবে।

(৩) সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যে তারিখ নির্ধারণ করিবে সেই তারিখে ইহা কার্যকর হইবে।
 

Tuesday, September 29, 2015

নিত্য কর্ম করার নিয়ম

ত্রিসন্ধ্যা বা নিত্য কর্ম করার নিয়ম
১। সূর্যোদয়ের কমপক্ষে আধঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠতে হবে। (একে বলে ব্রাহ্ম মুহুর্তে উঠা) ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে যাদের দীক্ষা হয়েছে তারা গুরু স্মরণ করে গুরু প্রদত্ত মন্ত্র এবং যাদের দীক্ষা বা (মন্ত্র) হয়নি তারা ঈশ্বরের যে কোন নাম জপ করবেন কমপক্ষে ১০৮ বার করে যতবার বেশি করা যায় জপ করবেন ও ঈশ্বরের স্মরণ ও মনন করবেন। এটা হল ১ম (সন্ধ্যা)। এটা সূর্য উঠার আধ ঘণ্টা পর পর্যন্ত চলতে পারে।
ঈশ্বর এক ও তাঁর নানা নাম, যেমন:
ওঁ (অউম্), দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর (শিব), রাম, কৃষ্ণ, রামকৃষ্ণ, হরি নারায়ণ ইত্যাদি।
তাই উক্ত যে কোন নামে তাঁকে ডাকতে হবে একেই বলে জপ। আর তাঁর রূপকে চিন্তা করাকেই বলে ধ্যান।
২। এভাবে স্নানের পর দুপুরে বা তার একটু আগে পরে একইভাবে কমপক্ষে ১০৮ বার করে যতবার পারবেন জপ করবেন। এভাবে ঈশ্বরের নাম করা ও তাঁর স্মরণ করা হল ২য় সন্ধ্যা।
৩। এভাবে সূর্যাস্তের অর্ধ ঘণ্টা পর থেকে শোবার আগে যে কোন সময়, তবে সন্ধ্যা আরতির সময় করা বেশী উত্তম। একই ভাবে ১০৮ বা অধিক বার তাঁর নাম জপ ও তাঁকে স্মরণ করতে হবে। এটি হল ৩য় সন্ধ্যা।
এভাবে ত্রিসন্ধ্যা করা একান্ত কর্তব্য (এছাড়াও শোবার সময় উঠার সময় হাই তোলার সময়, হাঁচি, কাশিতে সর্বদা তাঁর নাম করতে হয়)। মনে রাখতে হবে ঈশ্বরকে মহিলা, পুরুষ, আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা, শরীরের যে কোন অবস্থায় যে কোন কালে, যে কোন স্থানে এমনকি বাথরুমেও তাঁর নাম মনে মনে করবেন। কারণঃ
শ্রীমদ্ভাগবত গীতার ৮/৫ শ্লোকে আছে-
অন্তকালে চ মামেব স্মরণ মুক্তা কলেবরম্
য়ঃ প্রয়াতি স মদ্ভাবং য়াতি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ ।।
অর্থাৎ মৃত্যুকালে বা দেহত্যাগকালে যে ঈশ্বরকে স্মরণ করে বা তাঁর নাম করে সে আমার ভাব অর্থাৎ ঈশ্বরকে প্রাপ্ত হয় বা ঈশ্বর লাভ করে। মৃত্যু মানুষকে যে কোন সময় গ্রাস করে, বলে কয়ে আসে না। তাই যে কোন স্থানে দেহের যে কোন অবস্থায় মন্দিরে-শৌচালয়ে যে কোন স্থানে তাঁর নাম করা কর্তব্য।
তাই সর্বদা এমনকি শৌচ কালেও ঈশ্বরকে মনে মনে ডাকা (জপ) স্মরণ (ধ্যান) করা যায়। সুতরাং যাদের দীক্ষা হয়েছে তারা তার গুরু নির্ধারিত ইষ্ট মন্ত্র জপ করবেন। যাদের দীক্ষা হয়নি তবুও তারা ঈশ্বরের যে কোন নামে জপ করতে পারে যেমন- ওঁ (অউম্), দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর (শিব), রাম, কৃষ্ণ, রামকৃষ্ণ, হরি নারায়ণ ইত্যাদি যে কোন নামে ডাকবেন।
সঙ্গে গায়ত্রী মন্ত্র জানা থাকলে সেটি পারলে জপ করা যায়।
গায়ত্রী মন্ত্রঃ
ওঁ ভুঃ ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্ বরেণ্যং ভর্গদেবস্য
ধীমহি ধিয়ো ইয়েনঃ প্রচোদয়াৎ ওঁ।
গায়ত্রীর অর্থঃ ভুঃ ভুবঃ স্বঃ অর্থ- স্বর্গ, মর্ত্য, অন্তরিক্ষ ব্রহ্মাণ্ড যাঁর থেকে উৎপন্ন হয়েছে সেই জ্যোতির্ময় পরমাত্মার ধ্যান করি, আমাদের বুদ্ধি (মতি) পরমাত্মার দিকে পরিচালিত হউক।
সর্বদা জানবেনঃ পূজার চেয়ে নামজপ বা নাম করা বড় তাঁর চেয়ে ঈশ্বরের ধ্যান করা আরো বড়। তাই জপ, ধ্যান অবশ্যই কর্তব্য। তবে বিশেষ দিনে পূজা করা কর্তব্য। জপ ধ্যান সর্বদা কর্তব্য।
তাছাড়াও শয়নকালে বা উঠার সময়, হাঁচি, কাশি, হাইতোলা যে কোন সময় যে কোন কর্মের শুরুতে ও শেষে তাঁর নাম করা কর্তব্য। যেমন- গা মোড়াবার সময় রাম রাম, হরিবোল, দুর্গা দুর্গা, হরে রাম হরে কৃষ্ণ ইত্যাদি। তাকে হরি ওঁ তৎ সৎ নামেও ডাকা যায়। আমাদের নিজ নিজ ব্যবসা ক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র ও যানবাহনে চলাচলে সর্বত্র বসে বসে বা হাটতে হাটতে ত্রিসন্ধ্যার সময় হলে মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকতে পারি। নাম করতে পারি।
তাই এখন থেকে আমাদের সকলের শ্লোগান হোকঃ
সম্প্রাদায় যার যার, সনাতন ধর্ম সবার।
ইষ্ট যার যার, সৃষ্টিকর্তা সবার।